এম.এল.এম ব্যবসার বিভিন্ন রূপ ও তার বিধান
এম.এল.এম ব্যবসার বিভিন্ন রূপ ও চিনার উপায়:
বর্তমানে এম.এল.এম ব্যবসা বিভিন্ন নামে অফলাইনে ও অনলাইনে পরিচালিত হচ্ছে। আমরা অনেকে তা না চিনার কারণে এসব নাজায়েজ কোম্পানিতে যুক্ত হয়ে পড়ছি এবং বিপদগ্রস্ত হচ্ছি।তাই এ বিষয়ে সচেতন হওয়া একান্তই জরুরী।
যেসব কোম্পানি কিংবা ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে দুটি বিষয় থাকবে,সেগুলো সবই নাজায়েজ এম.এল.এম ব্যবসার অন্তর্ভুক্ত।দুটি বিষয় হচ্ছে -
১)বিনিয়োগ ও শ্রমবিহীন বিনিময়গ্রহণ
২)বিনিময়বিহীন শ্রম
এম.এল.এম এর শরয়ী হুকুম:
মাল্টিলেভেল মার্কেটিং সিস্টেম শরীয়তের দৃষ্টিতে সম্পূর্ণ নাজায়েয ও হারাম। নাজায়েয হওয়ার কয়েকটি কারণ নিম্নে উল্লেখ করা হলো।
এক- শরীয়তের একটি মৌলিক দৃষ্টিভঙ্গি হলো, বেচা-কেনা হবে সরাসরি । বিনা প্রয়োজনে মধ্যসত্ত্বভোগী সৃষ্টি হবে না। ক্রেতা ও বিক্রেতার মাঝে অযাচিতভাবে বিভিন্ন স্তর ও মাধ্যম সৃষ্টি করা শরীয়তের পছন্দ নয়। এজন্যই ‘তালাক্কিয়ে জালাব’ ও ‘বাইয়ুল হাযির লিল বাদীর’ উপর নিষেধাজ্ঞা এসেছে। (সহীহ মুসলিম হা. নং ৩৭৯২, ৩৭৯৭)
দুই- শরীয়তে ক্রেতা তথা ভোক্তার স্বার্থ বিক্রেতা তথা ব্যবসায়ীর স্বার্থের উপর প্রাধান্য পায়। এ জন্য শরীআত দালালীকে অপছন্দ করে। (সহীহ মুসলিম হা নং ৩৭৯১) কারণ, এর দ্বারা বিক্রেতা ও দালাল উপকৃত হলেও ভোক্তা ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
শরীয়তের এ দুটি দৃষ্টিভঙ্গিই এম.এল.এম এর সাথে সাংঘর্ষিক। প্রথম উসূলটি ছিল, বেচাকেনায় অযাচিত মধ্যসত্ত্বভোগী সৃষ্টি না হওয়া। অথচ এম.এল.এম এর মধ্যে এক পণ্য বা সেবার উপকারভোগী হয় অনেক স্তরের লোক। কারণ, পরিবেশককে যে কমিশন দেওয়া হয় তা মূলত ক্রেতার অর্থ থেকেই দেওয়া হয়। এতে ক্রেতা চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কারণ, ক্রেতা এই একই মানের পণ্য সাধারণ বাজার থেকে কিনলে অনেক কমে কিনতে পারতো। অথচ এম.এল.এম কোম্পানি নিজ ডিষ্ট্রিবিউটরদের কমিশন দেওয়ার স্বার্থে ঐ একই মানের পণ্য প্রায় দ্বিগুণ মূল্যে বিক্রি করছে। আর এতে যেহেতু ভোক্তার স্বার্থ ক্ষুণ্ণ হচ্ছে তাই এই পদ্ধতি শরীয়ত সমর্থন করে না।
তিন- আল কুরআনে আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন ‘তোমরা বাতিল পন্থায় অন্যের মাল খেওনা’ এই আয়াতের ব্যাখ্যায় হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাযি. বলেন, বিনিময়হীন উপার্জনই হলো বাতিল পন্থার উপার্জন। ( আহকামুল কুরআন, জাসসাস ২/১৭২) এম.এল.এম এর মধ্যে বাতিল পন্থায় অন্যের মাল ভক্ষণ করাও পাওয়া যায়। কারণ, এম.এল.এম কারবারে ডাউন লেভেল থেকে আপ লেভেলে যে কমিশন আসে তা বিনিময়হীন হাসিল হয়। অতএব, এই কমিশন অন্যের সম্পদ বাতিল পন্থায় আহরণের অন্তর্ভুক্ত।
চার- লেন-দেনের ক্ষেত্রে শরীয়তের একটি উসূল হলো চুক্তির সময় পণ্য বা সেবা সুনির্ধারিত হতে হবে। যেন এ নিয়ে পরবর্তীতে ঝগড়া-বিবাদ না হয়। কিন্তু এম.এল.এম এই উসূলেরও পরিপন্থী। কারণ, এম.এল.এম এর একজন ক্রেতা-পরিবেশক কোম্পানিকে তার নির্ধারিত টাকাগুলি দিচ্ছে দুটি জিনিসের বিনিময়ে ১. নির্ধারিত পণ্য বা সেবা । ২. পরিবেশক হিসেবে কমিশন প্রাপ্তি। আমরা দেখতে পাচ্ছি যে বিনিময়ের প্রথমটি জানা থাকলেও দ্বিতীয়টি অজানা। কারণ, ক্রেতা নিজের ডানে-বামে সদস্য বানাতে পারবে কিনা , পারলেও দুজন বানাতে পারবে কিনা, কমিশন সে কোন সময় থেকে পেতে শুরু করবে, কত স্তর পর্যন্ত চলবে, এসব কিছুই অনির্ধারিত, অজানা। তাই এই উসূল অনুযায়ীও এম.এল.এম শরীয়ত বিরোধী।
পাঁচ- বেচাকেনার মধ্যে আর একটি শর্ত হলো বেচা-কেনা “গরর তথা প্রতারণা মুক্ত হতে হবে। আল মাবসূত এর ভাষ্যানুযায়ী “গরর হলো, এমন চুক্তি যার পরিণাম অজানা। (কিতাবুল মাবসূত ১২/১৯৪) এম.এল.এম এর মধ্যেও “গরর এর উপস্থিতি রয়েছে। পরিবেশক কোম্পানির সাথে চুক্তি অনুযায়ী নিজ ডাউন লেভেল থেকে কমিশন লাভ করতে থাকবে। অথচ তার ক্ষেত্রে আদৌ ডাউন লেভেল সৃষ্টি হবে কিনা, হলে তা কতদিন এবং কয়টি স্তর পর্যন্ত চলবে তা সম্পূর্ণ অনিশ্চিত। যা শরীয়তের নিষিদ্ধ “আল গরর" এর বাস্তব দৃষ্টান্ত।
ছয়- হাদীস শরীফে একই কারবারের মধ্যে আরেকটি কারবারকে শর্ত করতে নিষেধ করা হয়েছে। (মুসনাদে আহমাদ ১/৩৯৮) অথচ এম.এল.এম এর মধ্যে এক কারবারকে আরেক কারবারের শর্ত করা পাওয়া যায়। তা এভাবে যে, এম.এল.এম কোম্পানিগুলোতে পণ্য ক্রয়ের শর্তেই শুধু পরিবেশক হওয়া যায়। অর্থাৎ কোম্পানি থেকে পণ্য ক্রয় ছাড়া পরিবেশক হওয়ার কোন সুযোগ নেই। তাহলে দেখা যাচ্ছে, এখানে পণ্য ক্রয়কে পরিবেশক হওয়ার জন্য শর্ত করা হয়েছে। যা হাদীসে নিষেধ করা হয়েছে।
কোনও কোনও এম.এল.এম কোম্পানি উপরিউক্ত শরয়ী সমস্যা এড়ানোর জন্য দুটি পৃথক ফরমে ব্যবস্থা করেছে। একটি পণ্য খরিদের অর্ডার ফরম, অন্যটি পরিবেশক হওয়ার আবেদন ফরম। এভাবে হয়তো তারা বুঝাতে চাচ্ছে যে, এখানে পৃথক দুটি চুক্তি হচ্ছে। অথচ এসব কোম্পানির সাথে জড়িত সবাই জানে যে, কার্যক্ষেত্রে একটি চুক্তির জন্য অন্যটি এখনো জরুরী শর্ত। অর্থাৎ পণ্য ক্রয় ছাড়া (দুটি ফরম করা সত্ত্বেও) পরিবেশক হওয়ার কোন উপায় নেই। সুতরাং দুটি ফরম করার দ্বারা এক কারবারের মধ্যে আরেকটি কারবার শর্ত করার নিষেধাজ্ঞা থেকে বের হওয়া যায়নি; বরং তা আগের অবস্থাতেই বহাল আছে।
সাত- বিনিময় বিহীন শ্রম এবং শ্রমবিহীন বিনিময় শরীয়তে নিষিদ্ধ। অথচ এম.এল.এম এর মধ্যে এই উভয় সমস্যা বিদ্যমান। বিনিময় বিহীন শ্রম এভাবে পাওয়া যায় যে, এম.এল.এম কোম্পানিগুলোর নিয়ম হলো একজন পরিবেশক যতক্ষণ পর্যন্ত নিজের ডানে-বামে দুজন সদস্য বানাতে না পারবে ততক্ষণ পর্যন্ত সে কমিশন পাবে না। অথচ এমটি হওয়া খুব স্বাভাবিক যে, এই পরিবেশক প্রাণান্ত চেষ্টা করার পরও ডানে-বামে দুজন ক্রেতা জোগাড় করতে পারেনি কিংবা পারলেও নির্ধারিত পয়েন্টের ক্রেতা আনতে পারেনি। অথবা একজন জোগাড় করতে পেরেছে আরেকজন জোগাড় করতে পারেনি। এসব ক্ষেত্রে এই পরিবেশক শ্রম দেয়া সত্ত্বেও কোম্পানি থেকে এক পয়সাও কমিশন পাবে না। আর এই বিনিময় বিহীন শ্রমকেই শরীয়ত নিষেধ করেছে।
বর্তমানে কিছু কিছু কোম্পানি একজন ক্রেতা জোগাড় করতে পারলেও কমিশন দিচ্ছে । কিন্তু এভাবেও বিনিময় বিহীন শ্রম এর নিষেধাজ্ঞা থেকে বের হওয়া সম্ভব নয়। কেননা কেউ চেষ্টা করলো, কিন্তু কাউকে ক্রেতা বানাতে পারলো না তখন তো কোম্পানি তাকে শ্রমের বিনিময়স্বরূপ কিছু দিচ্ছে না।
আর শ্রমহীন বিনিময় এভাবে পাওয়া যায় যে, কোন ব্যক্তি নির্ধারিত পরিমাণ পণ্য খরিদান্তে পরিবেশক হওয়ার পর যদি সে দুজন ক্রেতা কোম্পানির জন্য নিয়ে আসে এবং তারা প্রত্যেকে আরো দুজন করে চারজনকে এবং এ চারজন দুজন করে আরো আটজনকে কোম্পানির সাথে যুক্ত করে, তবে প্রথম ব্যক্তি ২য় লেভেলের দু’ ব্যক্তি নিজের ডাউন লেভেলে আট ব্যক্তি ক্রেতা-পরিবেশক হওয়ার সুবাদে কোম্পানি থেকে কমিশন পেয়ে থাকে। অথচ এ আটজনের কাউকেই প্রথম ব্যক্তি ও দ্বিতীয় স্তরের দুজন কোম্পানির সাথে যুক্ত করেনি; বরং এরা কোম্পানির সাথে যুক্ত হয়েছে সরাসরি তাদের উপরের ব্যক্তিদের রেফারেন্সে। তা সত্ত্বেও উপরের লেভেলের ব্যক্তিরা তাদের অন্তর্ভুক্তির কারণে নিজের কোন শ্রম ছাড়াই পারিশ্রমিক পাচ্ছে। আর এটাই শরীয়তের নিষিদ্ধ “শ্রমবিহীন বিনিময়ে”র বাস্তব দৃষ্টান্ত।
শরীয়তের দৃষ্টিতে এম.এল.এম নিষিদ্ধ হওয়ার কয়েকটি কারণ উল্লেখ করা হলো। এ কারণগুলো ছাড়া আরো এমন কিছু সমস্যা রয়েছে যেসব সমস্যার কারণেও এম.এল.এম অবৈধ প্রমাণিত হয়।