কুরবানীর মান্নতকারী মান্নতের পশুর গোশত ভক্ষণ করতে পারবে কিনা?


কুরবানীর মান্নতকারী মান্নতের পশুর গোশত ভক্ষণের শরয়ী বিধান:

যেকোনো মান্নতের পশুর গোশত মান্নতকারী খেতে পারবে না। বরং তা গরীবদেরকে সম্পূর্ণ সদকা করে দেওয়া ওয়াজিব।যারা কুরবানীর মান্নতের ক্ষেত্রে মান্নতকারীর জন্য পশুর গোশত খাওয়াকে জায়েজ বলেন,তারা ভুলের উপর আছেন।নিম্নে এ সম্পর্কে কিছু দলীল পেশ করা হলো- 


সাহাবা ও তাবেয়ীনের আসারের আলোকে মান্নতের পশুর গোশত খাওয়ার বিধান:

সাহাবা-তাবেয়ীন থেকে ব্যাখ্যামুক্তভাবেই প্রমাণিত আছে যে, মান্নতকারী মান্নতের পশুর গোশত খেতে পারবে না। নিম্নে এ সংক্রান্ত কয়েকটি আসার উল্লেখ করা হল।


  • আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. বলেছেন-


من كل الهدي يؤكل إلاما كان من فداء أو جزاء أو نذر


সর্বপ্রকার হাদীর গোশত খাওয়া যাবে। তবে ফিদয়া, জাযা ও মান্নতের পশুর গোশত খাওয়া যাবে না। -আহকামুল কুরআন, জাসসাস ৩/২৩৭


  • আবদুল্লাহ ইবনে উমর রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন-


لا يؤكل من جزاء الصيد والنذر، ويؤكل مما سوى ذلك


শিকারের জরিমানা দম এবং মান্নতের পশুর গোশত খাওয়া যাবে না। এ ছাড়া বাকিগুলোর গোশত খাওয়া যাবে। -সহীহ বুখারী ১/২৩২


  • বিখ্যাত তাবেয়ী মুজাহিদ রাহ. বলেন-


جزاء الصيد، والفدية، والنذر لا يأكل منها صاحبها، ويأكل من التطوع والتمتع


শিকারের জাযা, ফিদইয়ার জাযা ও মান্নতের পশুর গোশত মালিক খেতে পারবে না। সে নফল হাদী ও তামাত্তু হজে¦র কুরবানীর গোশত খেতে পারবে। -তাফসীরে তাবারী ২/২৫০


  • আতা রাহ. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন-


لا يؤكل من جزاء الصيد، ولا من النذر، ولا من الفدية، ويؤكل مما سوى ذلك


শিকারের জরিমানা দম থেকে খাওয়া যাবে না, মান্নতের পশু থেকে খাওয়া যাবে না, ফিদইয়ার পশু থেকে খাওয়া যাবে না। এছাড়া বাকি পশু থেকে খাওয়া যাবে। -তাফসীরে তাবারী ২/২৫০


অনুরূপ বলেছেন আলী ইবনে আবী তালিব রা., সায়ীদ ইবনে জুবাইর রাহ., আতা রাহ.।


দেখুন : মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা, বর্ণনা ১৩৩৬৫-৬৬; আহকামুল কুরআন, জাসসাস ৩/২৩৭, তাফসীরে তাবারী ২/২৫০


সাহাবায়ে কেরাম ও তাবেয়ীনের উক্ত আসারগুলো থেকে প্রমাণিত যে, মান্নতকারীর জন্য মান্নতের পশুর গোশত খাওয়া জায়েয নয়। এতে কুরবানী বা গায়রে কুরবানীর কোনো পার্থক্য করা হয়নি।


ফিকহ-ফতোয়ার উদ্ধৃতি:


এক. আলআজনাস, ইমাম আবুল আব্বাস আননাতিফী রাহ. (৪৪৬ হি.) 

কিতাবুল উযহিয়্যাহ-এ তিনি বলেন-

و في نوادر هشام عن محمد إذا نذر ذبح شاة لا يأكل منها الناذر ولو أكل عليه قيمة ما أكل

হিশাম রাহ. ইমাম মুহাম্মাদ রাহ. থেকে বর্ণনা করেন, কোনো ব্যক্তি যদি ছাগল জবাইয়ের মান্নত করে তবে তা থেকে মান্নতকারী খেতে পারবে না। যদি খায় তাহলে যে পরিমাণ খেয়েছে, তার মূল্য সদকা করে দিতে হবে। -আলআজনাস, নাতিফী ১/৫১০)

প্রশ্ন হতে পারে, ইমাম মুহাম্মাদ রাহ. -এর উক্ত বক্তব্য তো  نذر بالذبح অর্থাৎ জবাইয়ের মান্নত সংক্রান্ত, نذر অর্থাৎ কুরবানীর মান্নত সম্পর্কিত নয়।


উত্তরে বলব, ‘খুলাসাতুল ফাতাওয়া’র গ্রন্থকার  ‘আলআজনাস’- এর বরাতে সরাসরি نذر أن يضحي  (কুরবানী করার মান্নত করল) শব্দ-ই ব্যক্ত করেছেন। লক্ষ করুন খুলাসার বক্তব্য-


ولو نذر أن يضحي ولم يسم شيئا يقع على الشاة، ولايأكل الناذر منها، ولو أكل منها فعليه قيمتها في الأجناس، والله أعلم


কোনো ব্যক্তি যদি কুরবানী করার মান্নত করে, কিন্তু কোন্ ধরনের পশু কুরবানী করবে তা উল্লেখ না করে তবে তাকে একটি ছাগল কুরবানী করতে হবে। আর মান্নতকারী তা থেকে খেতে পারবে না। যদি খায় তবে তাকে এর মূল্য সদকা করে দিতে হবে। -খুলাসাতুল ফাতাওয়া, ৪/৩২০


ছাহেবে খুলাসা ষষ্ঠ শতাব্দী হিজরীর হানাফী মাযহাবের শীর্ষস্তরের ফকীহ ও ইমাম ছিলেন। যিনি মুজতাহিদ ফীল মাসায়িল ছিলেন। স্পষ্টভাবেই  তিনি আজনাস-এর হাওয়ালায় মান্নতের কুরবানী মান্নতকারী খেতে পারবে না ব্যক্ত করেছেন।


অথচ আলআজনাস-এ ইমাম মুহাম্মাদ থেকে আছে  إذا نذر ذبح شاة  - তিনি نذر ذبح شاة  -এর রেওয়ায়েত বিল মা‘না করেছেন। যা দ্বারা ইমাম মুহাম্মাদ রাহ.-এর উক্ত বক্তব্যের মর্ম ও (প্রয়োগক্ষেত্র) সুস্পষ্ট হয়ে যায়। অর্থাৎ তাঁর উক্ত বক্তব্য কুরবানীর মান্নতের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। এতে আরেকটি বিষয়ও প্রমাণিত হয়ে যায় যে, نذر بالذبح এবং نذر بالأضحية এ দুয়ের মধ্যে বিধানগত দিক বিবেচনায় কোনো পার্থক্য নেই। সুতরাং ছাহেবে খুলাসার বিশ্লেষণ অনুযায়ী ইমাম মুহাম্মাদ রাহ.-এর বক্তব্য থেকেই প্রমাণিত হয়ে যায় যে, কুরবানীর মান্নতের গোশত মান্নতকারী খেতে পারবে না।


দুই. আন নিহায়া, হুসামুদ্দীন সিগনাকী রাহ. (মৃত্যু ৭১০ হি)

ইমাম মুহাম্মাদ রাহ.-এর উক্ত বক্তব্য যে কুরবানীর মান্নতের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য তা হুসামুদ্দীন সিগনাকী রাহ.-এর বক্তব্য থেকেও প্রমাণিত। তিনি বলেন-


وأما في الأضحية المنذورة سواء كانت من الغني أو الفقير فليس لصاحبها أن يأكل، ولا أن يؤكل، لأن سبيلها التصدق، وليس للمتصدق أن يأكل من صدقته، إلى هذا أشار في الذخيرة، وقال إذا نذر ذبح شاة لايأكل منها الناذر، ولو أكل فعليه قيمة ما أكل

আর মান্নতের কুরবানীর গোশত মান্নতকারী খেতে পারবে না। মান্নতকারী চাই ধনী হোক বা দরিদ্র। কেননা মান্নত হয়েই থাকে সদকার উদ্দেশ্যে। আর সদকাকারী নিজ সদকা থেকে খেতে পারে না। এ বিষয়টির দিকে ইঙ্গিত করেই যখীরাতে বলা হয়েছে-


إذا نذر ذبح شاة لايأكل منها الناذر ولو أكل فعليه قيمة ما أكل

আর আযযাখীরাতুল বুরহানীয়াহ-এর উক্ত বক্তব্য ইমাম মুহাম্মাদ রাহ.-এরই বক্তব্য; যা আমরা ইতিপূর্বে আলআজনাসের হাওয়ালায় উল্লেখ করেছি। -আননিহায়া ২/৪৫৩ (মাখতূত, নূর উসমানীয়া)

সিগনাকী রাহ.-এর বক্তব্য থেকেও বোঝা গেল যে, نذر بالذبح   এবং نذر بالأضحية এ দুয়ের মধ্যে বিধানগত দিক থেকে কোনো পার্থক্য নেই।


তিন. ফয়যুল মাওলাল কারীম, ইবরাহীম আলকারাকী রাহ. (৯২২ হি.)

আলআজনাসের হাওয়ালায় বলেন-

ولو نذر أن يضحي ولم يسم شيئا يقع على الشاة، ولكن الناذر لا يأكل منها، ولو أكل فعليه قيمتها، كذا في الأجناس

কোনো ব্যক্তি যদি কুরবানী করার মান্নত করে, কিন্তু কোন্ ধরনের পশু কুরবানী করবে তা উল্লেখ না করে তবে তাকে একটি ছাগল কুরবানী করতে হবে। আর মান্নতকারী তা থেকেখেতে পারবে না। যদি খায় তবে তাকে এর মূল্য সদকা করে দিতে হবে। -ফয়যুল মাওলাল কারীম আলা আবদিহী ইবরাহীম, পৃষ্ঠা ৩০৪


চার. ‘মাজমাউল আনহুর’, দামাদ আফিন্দী রাহ. (১০৭৮ হি.)


ولو نذر أن يضحي ولم يسم شيئا يقع على الشاة، ولا يأكل الناذر منها، ولو أكل فعليه قيمة ما أكله؛ لأن سبيلها التصدق وليس للمتصدق أن يأكل من صدقته


-মাজমাউল আনহুর ৪/১৭০


পাঁচ. ফাতাওয়া বাযযাযিয়াহ, ইবনুল বাযযায আলকারদারী রাহ. (৮২৭ হি.)


نذر أن يضحي ولم يسم شيئا، عليه شاة ولا يأكل منها، وإن أكل عليه قيمتها

-ফাতাওয়া বাযযাযিয়াহ ৬/২৯২


ছয়. ফাতাওয়া হিন্দিয়া, নিযামুদ্দীন আল বুরহানপুরী


نذر أن يضحي ولم يسم شيئا، عليه شاة ولا يأكل منها، وإن أكل عليه قيمتها، كذا في الوجيز للكردري

-ফাতাওয়া হিন্দিয়া, খ. ৫, পৃ. ২৯৫


উল্লেখ্য যে, উপরিউক্ত বরাতসমূহে نذر أن يضحي শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। যা মূলত আল আজনাস থেকেই গৃহিত।


সাত. আততাজরীদ, ইমাম কুদুরী রাহ. (৪২৮ হি.)

আততাজরীদ গ্রন্থে কিরান এবং তামাত্তুর দম অর্থাৎ হজ্জের কুরবানীর গোশত খাওয়া জায়েয হওয়ার একটি কারণ ব্যক্ত করেছেন এই বলে যে-


ولأنه دم لم يجب بإيجابه، ولا بأمر الإحرام جنسه، فجاز الأكل منه، كالأضحية، ولأن من جاز له أكل الأضحية جاز له أكل دم المتعة


এটি অর্থাৎ দমে শোকর এমন দম, যা নিজের উপর ওয়াজিব করে নেয়ার কারণে ওয়াজিব হয়নি এবং ইহরাম অবস্থায় নিষিদ্ধ কাজ করার কারণেও নয়। তাই তা খাওয়া জায়েয আছে। যেমন কুরবানীর গোশত খাওয়া জায়েয। -আততাজরীদ ৪/২১৯২


উপরোক্ত বক্তব্যে ইমাম কুদুরী রাহ.-এর-

ولأنه دم لم يجب بإيجابه


-কথাটি বিশেষভাবে লক্ষণীয়। তিনি উক্ত বক্তব্যে দমে তামাত্তু ও কিরান কেন খেতে পারবে তার কারণ ব্যক্ত করেছেন এবং উপমা হিসেবে তিনি কুরবানীর কথা তুলে ধরেছেন। আর তা এই যে, এসব কুরবানীর গোশত এজন্য খাওয়া জায়েয, যে ব্যক্তি নিজের উপর তা আবশ্যক করে নেয়নি; বরং নুসুক অর্থাৎ ইবাদত হিসেবে শরীয়ত কর্তৃক তার ওপর ওয়াজিব হয়েছে। যেমনটি কুরবানীর নেসাবের মালিকের উপর ওয়াজিব হয়েছে।


সুতরাং ইমাম কুদুরী রাহ.-এর উক্ত বক্তব্য থেকে খুব সহজেই বুঝে আসে, যে পশুর কুরবানী বান্দার উপর পূর্ব থেকে ওয়াজিব নয়, বরং বান্দা নিজের উপর নিজে ওয়াজিব করে নেয় (যেমন মান্নতের কুরবানী) তার গোশত খাওয়া কুরবানীদাতার জন্য জায়েয নয়; বরং তা সদকা করে দেয়া আবশ্যক।


আট. বাদায়েউস সানায়ে


ইমাম কাসানী রাহ. (৫৮৭ হি.)-এর নিম্নোক্ত বিশ্লেষণ থেকে স্পষ্ট হয়ে যায় যে, মান্নতের কুরবানীর গোশত মান্নতকারী খেতে পারবে না; বরং তা সদকা করে দিতে হবে। তিনি বলেন-

ولا يجوز له أن يأكل من دم النذر شيئا

وجملة الكلام فيه أن الدماء نوعان نوع يجوز لصاحب الدم أن يأكل منه وهو دم المتعة والقران والأضحية، وهدي التطوع إذا بلغ محله

ونوع لايجوز له أن يأكل منه وهو دم النذر والكفارات، وهدي الإحصار وهدي التطوع إذا لم يبلغ محله؛ لأن الدم في النوع الأول دم شكر فكان نسكا، فكان له أن يأكل منه، ودم النذر دم صدقة، وكذا دم الكفارة في معناه؛ لأنه وجب تكفير الذنب

-বাদায়েউস সানায়ে ২/৪৭৭


ইমাম কাসানী রাহ.-এর উপরোক্ত বক্তব্যে পশুকে দুই ভাগে বিভক্ত করেছেন। প্রথম প্রকারে তিনি সেসকল পশুর আলোচনা করেছেন, যার গোশত খাওয়া যাবে। সেখানে তিনি দমে তামাত্তু, দমে কিরান, ঈদুল আযহার কুরবানী ও নফল হাদীকে উল্লেখ করেছেন। এর কারণ ব্যক্ত করেছেন যে, এগুলো হল দমে শোকর। এতে এটা স্পষ্ট যে, এর দ্বারা তিনি সাধারণ কুরবানী উদ্দেশ্য করেছেন, মান্নতের কুরবানী উদ্দেশ্য করেননি। কারণ, মান্নতের কুরবানী দমে শোকর নয়। আর যেগুলো দমে শোকর সেগুলো তো নুসুক অর্থাৎ আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে নির্ধারিত ইবাদত।


পক্ষান্তরে দ্বিতীয়ভাগে তিনি ঐসকল পশুর আলোচনা এনেছেন, যা থেকে পশুর মালিক খেতে পারে না। এ প্রকারে প্রথমেই তিনি মান্নতের পশুর কথা এনেছেন। তাহলে এ থেকে খুব সহজভাবেই বোঝা যায় যে, প্রথম প্রকারে যে কুরবানীর কথা এসেছে তা মান্নতের নয়; বরং মান্নতমুক্ত সাধারণ কুরবানী। আর দ্বিতীয় ভাগে মান্নত দ্বারা সকল প্রকার মান্নতের কুরবানীই অন্তর্ভুক্ত এবং তা সদকাযোগ্য। মান্নতকারীর জন্য তা খাওয়া জায়েয নয়। সুতরাং ইমাম কাসানী রাহ.-এর উপরোক্ত শ্রেণীভাগ দ্বারা সুস্পষ্টভাবেই মান্নতের কুরবানীর ব্যাপারে শরীয়তের বিধান জানা গেল এবং তাঁর মতও পরিষ্কার হয়ে গেল।


উল্লেখ্য, ইমাম কাসানী রাহ. থেকে কুরবানীর অধ্যায়ে যে মান্নতের কুরবানীর গোশত খাওয়ার কথা ব্যক্ত হয়েছে, এর দ্বারা উদ্দেশ্য হলো ধনী ব্যক্তি যদি কুরবানীর মান্নত দ্বারা নিজের উপর যে ওয়াজিব কুরবানি রয়েছে, তা উদ্দেশ্য  নিয়ে থাকে, তাহলে ঐ মান্নত সহীহ না হওয়ায় সে ঐ কুরবানির  গোশত খেতে পারবে।


নয়. ইমাম শামসুল আইম্মাহ সারাখসী রাহ. (৪৮৩ হি.)


ইমাম সারাখসী রাহ. হজ্জের মান্নতের কুরবানী প্রসঙ্গে যে আলোচনা করেছেন তাতেও প্রমাণিত হয়ে যায় যে, মান্নতের কুরবানী সদকাযোগ্য। মান্নতকারীর জন্য খাওয়া জায়েয নয়।


কারণ, ‘মান্নতের হাদীর গোশত মান্নতকারীর জন্য খাওয়া জায়েয নয়’- এই মাসআলার ‘ইল্লত’ ইমাম সারাখসী রাহ. এই বয়ান করেছেন যে, মান্নতের কারণে মান্নতের পশু আল্লাহর জন্য ‘খাস’ হয়ে গেছে। তাই এই পশুর গোশত সদকা করা জরুরি।


وكل هدي جعله على نفسه من الإبل والبقر والغنم فعليه أن يذبحه بمكة.. وبعد الذبح صار المذبوح لله تعالى خالصا، فالسبيل أن يتصدق بلحمه


পক্ষান্তরে -হজ্জে তামাত্তুর কুরবানী, হজ্জে কিরানের কুরবানী এবং হজে¦র নফল কুরবানী- এইসকল কুরবানীর গোশত কুরবানীদাতার জন্য খাওয়া জায়েয’- তিনি এই মাসআলার ইল্লত লিখেছেন-এইসকল কুরবানী ঈদুল আযহার কুরবানীর মতো, যাতে গোশত সদকা করা ওয়াজিব হয় না। বরং কেবল পশু যবাই করার দ্বারাই কুরবানীর মাকসাদ হাসিল হয়ে যায়।


এরপর গোশত চাই নিজে খেল বা অন্যদের খাওয়াল, কিংবা সদকা করে দিল। তবে উত্তম হল, এক তৃতীয়াংশ সদকা করবে আর দুই তৃতীয়াংশ নিজের কাজে লাগাবে। সারাখসী রাহ. আরও লিখেছেন যে, এই হুকুমই প্রযোজ্য হবে হজে¦র প্রত্যেক ঐ কুরবানীর ক্ষেত্রে, যেগুলো ঈদুল আযহার কুরবানীর মতো। (দ্রষ্টব্য : আল মাবসূত, সারাখসী ৪/ ১৩৬)


ইমাম সারাখসী রাহ.-এর উপরোক্ত উভয় বক্তব্য থেকে একথা পরিষ্কার হয়ে গেল যে, মান্নতের কুরবানীর গোশত মান্নতকারীর জন্য খাওয়া জায়েয নয়; বরং তা সদকা করা ওয়াজিব। কারণ, তা-

كل هدي جعله على نفسه

-এর অন্তর্ভুক্ত। ঈদুল আযহার সাধারণ কুরবানী খোদ শরীয়ত ওয়াজিব করেছে এবং যেখানে আল্লাহ তাআলার নামে পশু যবাই করার দ্বারাই ইবাদাতে ওয়াজিবা আদায় হয়ে যায়। সারাখসী রাহ.-এর দ্বিতীয় বক্তব্য এই-


ويباح التناول من هدي المتعة، والقران، والتطوع بمنزلة الأضحية، والجواب في الأضحية معلوم، وهو أن الواجب يتأدى بإراقة الدم فإنه يباح التناول منه للمضحي، ولمن شاء المضحي من غني أو فقير، فإن أكل المضحي كلها لم يكن عليه شيء، والأفضل له أن يتصدق بالثلث، ويأكل الثلثين، فكذلك فيما هو في معنى الأضحية من الهدايا


উপরোক্ত বক্তব্যে লক্ষণীয় বিষয় হল, ইমাম সারাখসী রাহ. তামাত্তু ও কিরান হজে¦র কুরবানী এবং হজে¦র নফল কুরবানীর গোশত খাওয়া জায়েয বলেছেন। এগুলোকে কিয়াস করেছেন ঈদুল আযহার কুরবানীর ওপর। তিনি উক্ত বক্তব্যে হজে¦র মান্নতের কুরবানীকে অন্তর্ভুক্ত করেননি। যদি উযহিয়্যার মধ্যে মান্নতের উযহিয়্যাহ অন্তর্ভুক্ত হত তাহলে হজে¦র মান্নতের কুরবানীও بمنزلة الأضحية এবং-

فكذلك فيما هو في معنى الأضحية من الهدايا

-এর অধীনে হয়ে অন্তর্ভুক্ত হয়ে যেত। অথচ তা একেবারে অবাস্তব।

যেহেতু তিনি এখানে হজে¦র মান্নতের কুরবানীকে বাদ দিয়েছেন এবং হজে¦র অন্যান্য কুরবানীকে উযহিয়্যার উপর কিয়াস করেছেন, এ থেকে সহজেই বোঝা যায় যে, মান্নতের কুরবানীর গোশত খাওয়া জায়েয নয়। কারণ, মান্নতের কুরবানীর গোশত যদি সাধারণ কুরবানীর মতো খাওয়া জায়েয হয় তাহলে بمنزلة الأضحية এবং-

فكذلك فيما هو في معنى الأضحية من الهدايا

-এ কথাটি অর্থবহ থাকে না।

মোটকথা মান্নতের কুরবানীর গোশত খাওয়া মান্নতকারীর জন্য যে জায়েয নয়; তা আমাদের ফকীহগণের নিকট একটি স্বীকৃত মাসআলা। কোনো কোনো ফকীহ সুস্পষ্ট ভাষায় তা ব্যক্ত করেছেন। আর  কেউ কেউ স্বীকৃত বিষয় হওয়ার কারণে তা সুস্পষ্টভাবে ব্যক্ত করার প্রয়োজন মনে করেননি।


দশ. ফাতাওয়া জহীরিয়া, জহীরুদ্দীন আলবুখারী রাহ. (৬১৯ হি.)

হানাফী মাযহাবের বিখ্যাত ফকীহ জহীরুদ্দীন আলবুখারী রাহ. ‘কুরবানীর পশু থেকে উপকৃত হওয়া’ অধ্যায়ে বলেন-

الفصل الرابع في الانتفاع بالأضحية: (ح) ولو حلب اللبن من الأضحية قبل الذبح أو جز صوفها يتصدق به ولا ينتفع به، وإذا نذر ذبح شاة لا يأكل منها الناذر، فإن أكل كان عليه قيمته، ولا يعطى جلد الأضحية ولا لحمها، أجرة للذابح والسلاح

‘চতুর্থ পরিচ্ছেদ : কুরবানীর পশু দ্বারা উপকৃত হওয়া’-

কোনো ব্যক্তি যদি কুরবানীর জন্তু জবাই করার পূর্বে দুধ দোহন করে অথবা তার পশম কেটে নেয়, তবে তা সদকা করে দিতে হবে এবং তা থেকে সে উপকৃত হতে পারবে না। আর যদি বকরি জবাইয়ের মান্নত করে, তাহলে তা থেকে মান্নতকারী খেতে পারবে না। যদি খায়, তাহলে তার মূল্য সদকা করা আবশ্যক হবে। আর কুরবানীর পশুর চামড়া জবাইকারীকে বিনিময়স্বরূপ দেয়া যাবে না। -ফাতাওয়া জহীরিয়া, পৃ. ১৯৩ (মাখতূত, মাকতাবা সুলাইমানিয়া, ইস্তাম্বুল)


লক্ষ করার বিষয় হল, জহীরুদ্দীন বুখারী রাহ. ইমাম মুহাম্মাদ রাহ.-এর ছাগলের মান্নত সংক্রান্ত বক্তব্যকে-

الفصل الرابع في الانتفاع بالأضحية

-পরিচ্ছদে এনেছেন। এতে বোঝা যায় যে, ইমাম মুহাম্মাদ রাহ.-এর উক্ত বক্তব্য কুরবানী করার মান্নত হোক বা জবাই করার মান্নত, সব ধরনের মান্নতকে শামিল করে।


এগারো. আযযাখীরাতুল বুরহানীয়া, ইমাম বুরহানুদ্দীন ইবনে মাজাহ রাহ. (৬১৬ হি.)

আলমুহীতুল বুরহানীর গ্রন্থকারের স্বরচিত গ্রন্থ ‘আযযাখীরাতুল বুরহানীয়া’তে মান্নতের কুরবানীর আলোচনা প্রসঙ্গে বলেন-

الفصل الثالث في وجوب الأضحية بالنذر وما هو في معناه :

ذكر الزعفراني في "أضاحيه":أن من قال: لله علي أن أضحي بشاة، فإن كان موسراً، فعليه أن يضحي بشاتين؛ إلا أن يعني به ما يجب عليه؛ وهذا لأن النذر إيجاب ...وإن كان فقيراً فعليه شاة، فإن أيسر كان عليه شاتان؛ ما أوجب بالنذر وما وجب باليسار. وفي نوادر هشام: عن محمد رحمه الله إذا نذر ذبح شاة لا يأكل منها الناذر، ولو أكل فعليه قيمة ما أكل.

-আযযাখীরাতুল বুরহানিয়া ৮/৩১৪

উক্ত বক্তব্যে ইমাম বুরহানুদ্দীন ইবনে মাজাহ রাহ.-

في وجوب الأضحية بالنذر وما هو في معناه.

(মান্নতের দ্বারা কুরবানী আবশ্যক হওয়া এবং এর অন্তর্ভুক্ত বিষয়) শীর্ষক পরিচ্ছেদে কুরবানীর মান্নতের আলোচনায় ইমাম মুহাম্মাদ রাহ.-এর মান্নত সংক্রান্ত বক্তব্য-

إذا نذر ذبح شاة لا يأكل منها الناذر، ولو أكل فعليه قيمة ما أكل.

-উদ্ধৃত করেছেন। এটা সুস্পষ্টভাবেই ইমাম মুহাম্মাদ রাহ.-এর উক্ত কথার মর্ম ও প্রয়োগক্ষেত্রকে স্পষ্ট করে দেয়। অর্থাৎ মাযহাবের ইমাম থেকেই প্রমাণ দেয় যে, হানাফী মাযহাবে কুরবানীর মান্নতের পশুর গোশত খাওয়া মান্নতকারীর জন্য জায়েয নয়। যদি উক্ত বক্তব্য কুরবানীর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য না হত তাহলে ফকীহগণ উক্ত বক্তব্য মান্নতের কুরবানীর প্রসঙ্গে উদ্ধৃত করতেন না। দ্বিতীয়ত তারা সুস্পষ্ট করে দিতেন যে, এটি কেবল জবাইয়ের মান্নতের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, কুরবানীর মান্নতের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়।


 বারো. তাবয়ীনুল হাকায়েক, ফখরুদ্দীন যায়লায়ী রাহ. (৭৪৩ হি.)


ফখরুদ্দীন যায়লায়ী রাহ. কোন্ প্রকার কুরবানীর পশুর গোশত কুরবানীদাতা খেতে পারবে- এ প্রসঙ্গের আলোচনায় বলেন-


وهذا في الأضحية الواجبة والسنة سواء، إذا لم تكن واجبة بالنذر، وإن وجبت بالنذر فليس لصحابها أن يأكل منها شيئا، ولا أن يطعم غيره من الأغنياء، سواء كان الناذر غنيا أو فقيرا؛ لأن سبيلها التصدق، وليس للمتصدق أن يأكل من صدقته، ولا أن يطعم الأغنياء


এটি (কুরবানীর পশুর গোশত কুরবানীদাতা খেতে পারবে) ওয়াজিব ও নফল কুরবানীর ক্ষেত্রে, যখন কুরবানীটি মান্নতের কারণে আবশ্যক না হয়। যদি মান্নতের কারণে কুরবানীটি ওয়াজিব হয়ে থাকে তাহলে মান্নতকারীর জন্য তা থেকে কোনো কিছু খাওয়া এবং ধনী ব্যক্তিকে খাওয়ানো জায়েয নয়। মান্নতকারী চাই ধনী হোক বা দরীদ্র। কেননা মান্নতের খাতই হল সদকার খাত। আর সদকাকারীর জন্য নিজ সদকার বস্তু থেকে খাওয়া এবং ধনীকে খাওয়ানো জায়েয নয়। -তাবয়ীনুল হাকায়েক ৬/৪৮৬


যায়লায়ী রাহ.সহ পূর্বের ও পরের ফকীহগণ ব্যাপকভাবেই ব্যক্ত করেছেন যে, মান্নতের কুরবানীর পশুর গোশত মান্নতকারী খেতে পারবে না। কলেবর বৃদ্ধি পাবে বিধায় উদ্ধৃতি হিসাবে শুধু কিতাবের নাম ও খ--পৃষ্ঠা উল্লেখ করা হল। যেমন-


তের. শরহু মুখতাসারিল বেকায়াহ, আহমাদ ইবনে মুহাম্মাদ আশশুমুন্নী রাহ. (৮৭২ হি.), পৃ. ৪৪১ (মাখতূত, মাকতাবা আযহারিয়া)


চৌদ্দ. আলইনায়া, আকমালুদ্দীন বাবারতী রাহ. (৭৮৬ হি.), খ. ৮, পৃ. ৪৩৬


পনের. ফাতাওয়া হিন্দিয়া - খণ্ড. ৫, পৃ. ৩০০


ষোল. আলবিনায়া শরহুল হিদায়া, আল্লামা আইনী রাহ. (৮৫৫ হি.), খ. ১৪, পৃ. ৩৯৩


সতের. তাকমিলাতুল বাহরির রায়েক, হুসাইন আততূরী, খ. ৮, পৃ. ১৭৮


আঠারো. হাশিয়াতুশ শুরুম্বুলালী, খ. ১, পৃ. ২৭০


ঊনিশ. আল্লামা ইবনে আবিদীন শামী রাহ. (১২৫২ হি.)


(قوله ويأكل من لحم الأضحية إلخ) هذا في الأضحية الواجبة والسنة سواء، إذا لم تكن واجبة بالنذر، وإن وجبت به فلا يأكل منها شيئا، ولا يطعم غنيا،سواء كان الناذر غنيا أو فقيرا، لأن سبيلها التصدق، وليس للمتصدق ذلك، ولو أكل فعليه قيمة ما أكل. زيلعي


-রদ্দুল মুহতার ৬/৩২৭


আল্লামা ইবনে আবিদীন শামী রাহ.-এর উক্ত ইবারত ভালোভাবে লক্ষ করা দরকার। কারণ কোনো কোনো আলোচকের ইবনে আবিদীন শামী রাহ. এর বক্তব্য- কুরবানীর দিনে যদি মান্নতের পশু যবাই করা না হয়; বরং পরে যবাই করা হয় তাহলে ঐ মান্নতের কুরবানীর গোশত সদকা করে দেয়া আবশ্যক- এটি নজরে এসেছে ঠিক-ই, কিন্তু কুরবানীর মান্নতের গোশত যে মান্নতকারী কোনো সময়ই খেতে পারে না- তা হয়ত নজর এড়িয়ে গেছে!


বিশ. ফাতহু বাবিল ইনায়া, মোল্লা আলী কারী রাহ. (১০১৪ হি.) খ. ২, পৃ. ২৭২


একুশ. আওজাযুল মাসালিক, খ. ৯ পৃ. ২৪৭


উপরিউক্ত ফিকহ-ফতোয়ার কিতাবসমূহের উদ্ধৃতি থেকে সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হল যে, মান্নতের কুরবানীর গোশত মান্নতকারীর জন্য খাওয়া জায়েয নয়; বরং তা গরিব মিসকীনকে সদকা করে দেয়া ওয়াজিব। এটি হানাফী ফকীহগণের একটি স্বীকৃত মাসআলা; যাতে কোনো দ্বিমত নেই।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url