ফজরের জামাত চলা অবস্থায় সুন্নত পড়ার বিধান কি?
উত্তর:
بسم اللّٰه الرحمن الرحيم
ফজরের জামাত চলা অবস্থায় সুন্নত পড়ার বিধান:
এমতাবস্থায় দেখতে হবে যে,সুন্নত পড়ে ইমাম সাহেবকে কমপক্ষে দ্বিতীয় রাকাতে পাওয়ার সম্ভাবনা আছে কিনা? সম্ভাবনা থাকলে মসজিদের বাহিরে বা কাতার থেকে দূরে মসজিদের বারান্দায় বা কোণায় কিংবা খুঁটির আড়ালে ফজরের সুন্নত পড়ে নেওয়া সুন্নাহসম্মত আমল।কিন্তু জামাতের কাতারের মধ্যে কিংবা কাতারের নিকটে পড়লে মাকরূহে তাহরীমী তথা নাজায়েজ হবে।কারণ, অনেক সাহাবি ও তাবেয়ি থেকে ইকামত শুরু হওয়ার পর জামাত চলাবস্থায় ফজরের সুন্নত আদায় করার কথা এভাবেই প্রমাণিত আছে।এখানে তাদের কিছু আমল ও ফতোয়া উল্লেখ করা হল।
সাহাবা-তাবেয়ীদের কিছু আমল ও ফতোয়া:
১. আবু মূসা আশআরী রা. থেকে বর্ণিত, (কূফার গভর্নর) সায়ীদ ইবনে আস তাঁকে এবং হুযায়ফা ও আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা.-কে ফজরের নামাযের আগে ডাকলেন। তাঁরা (কাজ শেষে) তার কাছ থেকে বিদায় নিলেন। ইতিমধ্যে মসজিদে ফজরের নামাযের ইকামত শুরু হয়ে গেছে। ইবনে মাসউদ রা. মসজিদের একটি খুঁটির আড়ালে ফজরের দুই রাকাত (সুন্নত) পড়লেন। তারপর জামাতে শরীক হলেন। -শরহু মাআনিল আসার ১/৬১৯
বদরুদ্দীন আইনী রাহ. (৮৫৫হি.) বলেন, فأخرجه من ثلاث طرق صحاح ইমাম তহাবী রাহ. এটি তিনটি সহীহ সনদে বর্ণনা করেছেন। -নুখাবুল আফকার ৩/৬৮২
২. আবু মিজলায থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি ফজরের জামাত চলা অবস্থায় ইবনে আব্বাস ও ইবনে উমর রা.-এর সঙ্গে মসজিদে প্রবেশ করলাম। ইবনে উমর রা. জামাতের কাতারে প্রবেশ করলেন। আর ইবনে আব্বাস রা. ফজরের দুই রাকাত (সুন্নত) পড়লেন। তারপর জামাতে শরীক হলেন। -প্রাগুক্ত
বদরুদ্দীন আইনী রাহ. বলেন, فأخرجه من طريقين صحيحين ইমাম তহাবী রহ. এটি দুটি সহীহ সনদে বর্ণনা করেছেন। -নুখাবুল আফকার ৩/৬৮৩
৩. যায়েদ ইবনে আসলাম থেকে বর্ণিত, ইবনে উমর রা. মসজিদে এসে দেখেন, ফজরের জামাত চলছে। কিন্তু তাঁর ফজরের দুই রাকাত (সুন্নত) পড়া হয়নি। তিনি হাফসা রা.-এর কামরায় তা পড়লেন। তারপর জামাতে শরীক হলেন। -প্রাগুক্ত ১/৬২০-৬২১
বদরুদ্দীন আইনী রাহ. বলেন, فأخرجه من ثلاث طرق صحاح ইমাম তহাবী রাহ. এটি তিনটি সহীহ সনদে বর্ণনা করেছেন।’ -নুখাবুল আফকার ৩/৬৮৪
৪. আবু উবায়দুল্লাহ থেকে বর্ণিত, আবু দারদা রা. কখনো মসজিদে এসে দেখতেন, ফজরের জামাত চলছে। তিনি মসজিদের এক কোণায় (ফজরের) দুই রাকাত (সুন্নত) পড়ে নিতেন। তারপর জামাতে শরীক হতেন। -শরহু মাআনিল আসার ১/৬২১
বদরুদ্দীন আইনী রাহ. বলেন, فأخرجه بإسناد صحيح ইমাম তহাবী রাহ. এটি সহীহ সনদে বর্ণনা করেছেন। -নুখাবুল আফকার ৩/৬৮৪
৫. আবু উসমান নাহদী থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমরা কখনো মসজিদে এসে দেখতাম, উমর রা. (ফজরের) নামায শুরু করে দিয়েছেন। কিন্তু আমাদের ফজরের দুই রাকাত (সুন্নত) পড়া হয়নি। আমরা মসজিদের শেষ প্রান্তে তা পড়ে নিতাম। তারপর জামাতে শরীক হতাম। -প্রাগুক্ত
ইউসুফ বিন্নুরী রাহ. (১৩৯৭ হি.) বর্ণনাটি উদ্ধৃত করে লিখেছেন,
وهذا يدل على تعامل عام بينهم ، وأنه على علم من عمر في عهده وعدم إنكاره، وهذا يكون أقوى ما يتمسك به.
এ থেকে বোঝা যায় যে, এটা তাদের মাঝে ব্যাপকভাবে অনুসৃত ছিল এবং উমর রা. তা জানতেন; কিন্তু এর উপর আপত্তি করতেন না। এটা আলোচ্য বিষয়ে শক্তিশালী দলীল। -মাআরিফুস সুনান ৪/৭৬
৬. ইমাম শা‘বী থেকে বর্ণিত, একদা মাসরূক রাহ. ফজরের জামাত চলাকালে মসজিদে প্রবেশ করলেন। কিন্তু তাঁর ফজরের দুই রাকাত (সুন্নত) পড়া হয়নি। তিনি মসজিদের এক কোণায় তা পড়ে নিলেন। তারপর জামাতে শরীক হলেন। -মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, বর্ণনা ৬৪৭২
৭. কাসেম ইবনে আবী আইয়ুব থেকে বর্ণিত, সায়ীদ ইবনে জুবাইর রাহ. ফজরের জামাত চলা অবস্থায় মসজিদের দিকে এলেন। মসজিদে প্রবেশের আগে মসজিদের দরজায় (ফজরের) দুই রাকাত (সুন্নত) পড়ে নিলেন। -প্রাগুক্ত, বর্ণনা ৬৪৭৪
৮. ইউনুস ইবনে উবায়েদ থেকে বর্ণিত, হাসান বসরী রাহ. বলতেন, তা মসজিদের এক কোণায় পড়ে নিবে। তারপর জামাতে শরীক হবে। -প্রাগুক্ত, বর্ণনা ৬৪৭৩
হাসান বসরী রাহ. থেকে অনুরূপ ফতোয়া ইয়াযিদ ইবনে ইবরাহীমও বর্ণনা করেছেন। -দেখুন : শরহু মাআনিল আসার ১/৬২২
বদরুদ্দীন আইনী রাহ. বলেন, فأخرجه من طريقين رجالهما ثقات ইমাম তহাবী রহ. এটি দুই সূত্রে বর্ণনা করেছেন, উভয় সূত্রের রাবীগণ ছিকা। -নুখাবুল আফকার ৩/৬৮৬
৯. উসমান ইবনে আসওয়াদ থেকে বর্ণিত, মুজাহিদ রাহ. বলেন, যদি কখনো মসজিদে গিয়ে দেখ যে, ফজরের জামাত শুরু হয়ে গেছে কিন্তু তোমার সুন্নত পড়া হয়নি, তাহলে তা পড়ে নিবে- জামাতের এক রাকাত ছুটে যাবে বলে মনে হলেও। -প্রাগুক্ত, বর্ণনা ৬৪৭৯
১০. উবায়েদ ইবনে হাসান থেকে বর্ণিত, আমি (আবদুর রহমান) ইবনে মাকিল রাহ.-কে দেখেছি, তিনি (মসজিদের) দরজায় ফজরের দুই রাকাত (সুন্নত) পড়েছেন। -প্রাগুক্ত, বর্ণনা ৬৪৮৭
নিষেধাজ্ঞার হাদিসসমূহের উদ্দেশ্য :
কোনো কোনো সাহাবী নবীজীর সামনে ফজরের ইকামত চলাকালে মসজিদে সুন্নত পড়েছেন। এক্ষেত্রে নবীজী তাঁদেরকে সরাসরি নিষেধ করেননি বা এ কথা বলেননি যে, إذا أقيمت الصلاة فلا صلاة إلا المكتوبة (ফরযের ইকামত শুরু হলে অন্য নামায পড়া নিষেধ)। বরং তিনি বিভিন্ন কারণ উল্লেখ করেছেন। যদি ইকামত চলা অবস্থায় ফজরের সুন্নত পড়া সর্বাবস্থায় নাজায়েয হত, তাহলে তিনি স্পষ্ট নিষেধ করতেন বা বলতেন যে, ফরযের ইকামত শুরু হলে অন্য নামায পড়া নিষেধ। এখানে সংক্ষেপে এ ধরনের কয়েকটি বর্ণনার পর্যালোচনা করা হল।
বর্ণনা নং ১ :
عن عبد الله بن مالك ابن بحينة، أن رسول الله صلى الله عليه وسلم مر برجل يصلي، وقد أقيمت صلاة الصبح، فكلمه بشيء، لا ندري ما هو، فلما انصرفنا أحطنا نقول: ماذا قال لك رسول الله صلى الله عليه وسلم؟ قال: قال لي: يوشك أن يصلي أحدكم الصبح أربعا.
আবদুল্লাহ ইবনে মালেক ইবনে বুহায়না রা. থেকে বর্ণিত, ফজরের ইকামত চলাকালে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নামাযরত একলোকের পাশ দিয়ে গেলেন এবং তাকে কিছু বললেন কিন্তু আমরা তা বুঝিনি। নামায শেষে আমরা তাকে ঘিরে জিজ্ঞেস করলাম, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তোমাকে কী বলেছেন? বলল, বলেছেন, তোমাদের কেউ হয়তো ফজরের নামায চার রাকাত পড়বে? -সহীহ মুসলিম, হাদীস ৭১১
এ হাদীস থেকে বোঝা যায় যে, ফজরের ইকামত চলা অবস্থায় অন্য নামায নিষেধের কারণ হচ্ছে, এতে কারো এ কথা মনে হতে পারে যে, ফজরের ফরয নামায চার রাকাত। -দ্রষ্টব্য : ফাতহুল মুলহিম বিশরহি সহীহিল ইমাম মুসলিম ৪/৯৩
বর্ণনা নং ২ :
عن أبي سلمة بن عبد الرحمن أنه قال: سمع قوم الإقامة فقاموا يصلون، فخرج عليهم رسول الله صلى الله عليه و سلم فقال: أصلاتان معا؟ أصلاتان معا؟ وذلك في صلاة الصبح في الركعتين اللتين قبل الصبح.
আবু সালামা ইবনে আবদুর রহমান থেকে বর্ণিত, কিছু সাহাবী ইকামত শুনে (ফজরের সুন্নত) নামায পড়তে দাঁড়ালেন। এমন সময় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁদের মধ্যে আগমন করলেন। বললেন, দুই নামায এক সাথে? দুই নামায এক সাথে? -মুয়াত্তা মালেক ১/৯৮
এ হাদীস থেকে ইকামতের পর অন্য নামায নিষেধের দ্বিতীয় আরেকটি কারণ বের হয়। তা হল, এতে একই জায়গায় ফরয ও সুন্নত নামাযের মিশ্রণ হয়ে যায়।
বর্ণনা নং ৩ :
عن عبد الله بن سرجس، قال: دخل رجل المسجد ورسول الله صلى الله عليه وسلم في صلاة الغداة، فصلى ركعتين في جانب المسجد، ثم دخل مع رسول الله صلى الله عليه وسلم، فلما سلم رسول الله صلى الله عليه وسلم، قال: يا فلان بأي الصلاتين اعتددت؟ أبصلاتك وحدك، أم بصلاتك معنا؟
আবদুল্লাহ ইবনে সারজিস রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ফজরের নামায পড়াচ্ছিলেন। এমন সময় একলোক মসজিদে প্রবেশ করে এক কোণায় (ফজরের) দুই রাকাত (সুন্নত) পড়ল। তারপর জামাতে শরীক হল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সালাম ফিরিয়ে তাকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কোন্ নামাযকে ফরয গণ্য করেছ? একাকী যা পড়েছ তা, না আমাদের সাথে যা আদায় করেছ তা? -সহীহ মুসলিম, হাদীস ৭১২
এই হাদীস থেকে তৃতীয় আরেকটি কারণ জানা যায়। তা হল, ইকামতের পর সুন্নত পড়লে ইমামের সাথে বিরোধ দেখা যায়।
এ পর্যালোচনা থেকে বোঝা গেল যে, ফজরের ইকামত বা জামাত চলাকালে অন্য নামায নিষেধের কারণ হল তিনটি :
১. ফজরের ফরযকে চার রাকাত মনে করার আশংকা।
২. একই জায়গায় ফরজ ও সুন্নতের মিশ্রিতকরণ।
৩. ইমামের সাথে বিরোধ।
এবং এটাও স্পষ্ট যে, মসজিদের বাইরে সুন্নত পড়লে এ তিনটি কারণের কোনোটিই পাওয়া যায় না। তাই মসজিদের বাইরে ফজরের সুন্নত পড়তে কোনো অসুবিধা নেই। বরং পড়ে নেওয়াই উচিত। আর জামাতের কাতারের মধ্যে বা কাতারের নিকটে পড়লে সবগুলো কারণ পাওয়া যায়। এজন্য তা মাকরূহে তাহরিমী। আর কাতার থেকে দূরে বারান্দায় বা কোণায় পড়লে প্রথম দুটি কারণ থাকে না, তবে শেষটি আংশিক থাকে। এজন্য বাইরে জাগা থাকা অবস্থায় এমন করবে না। অবশ্য প্রয়োজনে কোনো কোনো ফকীহ এর অবকাশ এজন্য দিয়েছেন যে, অনেক বড় বড় সাহাবী-তাবেয়ী তা করেছেন। যেমন আমরা উদ্ধৃতিসহ তা পড়ে এসেছি।
সারকথা,
ফজরের জামাত চলাকালে মসজিদের বাইরে তো বটেই ভেতরেও জামাতের কাতার থেকে দূরে বারান্দায় বা মসজিদের এক কোণায় ফজরের সুন্নত পড়ে নেওয়া সুন্নাহসম্মত আমল। আর إذا أقيمت الصلاة فلا صلاة إلا المكتوبة -এ হাদীসটি ফজরের সুন্নত ছাড়া অন্যান্য নামাযের জন্য। ফজরের সুন্নত অধিক গুরুত্বপূর্ণ হওয়ায় অনেক বড় বড় সাহাবী-তাবেয়ী এই বিধানকে এ থেকে ব্যতিক্রম মনে করেছেন।
(এখানে ইবনে আব্বাস রা.-এর আমলটি বিশেষভাবে লক্ষণীয়। তিনি জামাত চলা অবস্থায় জামাতের কাতার থেকে দূরে ফজরের সুন্নত পড়তেন। অথচ একদা রাসূলুল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম মসজিদের ভেতরে সুন্নত পড়তে দেখে তাঁকে নিষেধ করেছিলেন। এর অর্থ এটাই যে, ওই নিষেধ ছিল জামাতের কাতারে বা তার নিকটে পড়ার জন্য। দূরে পড়লে নিষেধ নেই।)
এ কারণে যদি অন্তত এক রাকাত জামাতের সাথে পাওয়া যাবে বলে মনে হয়,তাহলে মসজিদের বাইরে তো বটেই ভেতরেও জামাতের কাতার থেকে দূরে বারান্দায় বা মসজিদের এক কোণায় তা পড়ে নিবে। এতে জামাতের ফযীলতও অর্জিত হয়ে যাবে এবং ফজরের সুন্নতের সওয়াবও হাসিল হয়ে যাবে। কিন্তু যদি এক রাকাতও পাওয়ার সম্ভাবনা না থাকে, তাহলে জামাতে শরীক হয়ে যাবে। ফজরের সুন্নত মর্যাদাপূর্ণ হলেও জামাতের মর্যাদা ও গুরুত্ব তার চেয়ে বেশি এবং জামাত পরিত্যাগের ব্যাপারে কঠোর সতর্ক বাণী এসেছে।
والله أعلم بالصواب