জন্মনিয়ন্ত্রণের শরয়ী হুকুম
প্রশ্ন:
জন্মনিয়ন্ত্রণের শরয়ী হুকুম কি?
উত্তর:
بسم اللّٰه الرحمن الرحيم
জন্মনিয়ন্ত্রণের পদ্ধতিসমূহ:
১.কৃত্রিম পদ্ধতি
২.প্রাকৃতিক পদ্ধতি
(১)কৃত্রিম পদ্ধতির শরয়ী বিধান:
কৃত্রিমভাবে জন্মনিয়ন্ত্রণের তিনটি পদ্ধতি রয়েছে।যেমন,
- এক. জন্মনিয়ন্ত্রণের স্থায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা, যার দ্বারা নারী বা পুরুষ প্রজনন ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে।
- দুই. অস্থায়ীভাবে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা, যার ফলে স্বামী-স্ত্রীর কেউ প্রজনন ক্ষমতাহীন হয়ে যায় না। যেমন, কনডম ব্যবহার করা, পিল সেবন করা ইত্যাদি।
- তিন. গর্ভধারনের পর গর্ভপাত ঘটানো।
১)প্রথম পদ্ধতি বা স্থায়ী পদ্ধতির হুকুম:
প্রথম পদ্ধতিটি গ্রহণ করা সর্বাবস্থায় হারাম।
দলীল:
وفي صحيح البخاري(٥٠٧٤)
عن الزهري قال : أخبرني سعيد بن المسيب،أنه سمع سعد بن أبي وقاص يقول : لقد رد ذلك -يعني النبي صلى اللّٰه عليه وسلم- على عثمان بن مظعون، ولو أجاز له التبتل لاختصينا.
অর্থাৎ- ইমাম যুহরী রহ. থেকে বর্ণিত,তিনি বলেন: আমাকে সাঈদ ইবনুল মুসাইয়াব বলেছেন যে, তিনি সা'দ বিন আবি ওয়াক্কাস রা. কে বলতে শুনেছেন-রাসূল صلى اللّٰه عليه وسلم ওসমান বিন মাজউন রা. এর খাসী হওয়ার আবেদনকে প্রত্যাখ্যান করেছেন।যদি রাসূল صلى اللّٰه عليه وسلم তাঁকে অনুমতি দিতেন,তাহলে আমরাও খাসী হতাম।(সহীহ বুখারী ৫০৭৪)
وفي عمدة القاري ٢٠ /١٠٢
إن الاختصاء في الآدمي حرام مطلقا
আল্লামা আইনী রহ. বলেন, মানুষের জন্য খাসী হওয়া সর্বাবস্থায় হারাম।(উমদাতুল কারী ২০/১০২)
২)দ্বিতীয় পদ্ধতি বা অস্থায়ী পদ্ধতির হুকুম:
এক্ষেত্রে আবার দুই পদ্ধতি রয়েছে।যেমন,
১.স্বল্পমেয়াদী।যেমন,আযল বা কনডম ব্যবহার করা।
২.দীর্ঘমেয়াদী।যেমন,পিল,ঔষধ কিংবা ইনজেকশন দেওয়া।
১.আযল বা কনডম ব্যবহারের হুকুম:
বিনা প্রয়োজনে আযল বা কনডম ব্যবহার করা মাকরূহ তথা অনুচিত।তবে যদি বদ আকীদা যুক্ত হয়,তাহলে তা নাজায়েজ হবে।যেমন,রিজিকের টেনশনে,কন্যা সন্তান হওয়ার ভয়ে,বেশী সন্তান নেওয়া লজ্জার কারণ মনে করে এ পদ্ধতি গ্রহণ করা বৈধ নয়।
বিশেষত অভাবের ভয়ে জন্মনিয়ন্ত্রণ করতে কুরআন মাজীদে নিষেধাজ্ঞা এসেছে।কেননা রিজিকের মালিক আল্লাহ তায়ালা। আল্লাহ তায়ালা বলেন,
وَلَا تَقْتُلُوا أَوْلَادَكُمْ خَشْيَةَ إِمْلَاقٍ ۖ نَّحْنُ نَرْزُقُهُمْ وَإِيَّاكُمْ ۚ إِنَّ قَتْلَهُمْ كَانَ خِطْئًا كَبِيرًا
দরিদ্রতার ভয়ে তোমরা তোমাদের সন্তানকে হত্যা কর না। তাদেরকে এবং তোমাদেরকে আমিই খাদ্য প্রদান করে থাকি।নিশ্চয় তাদেরকে হত্যা করা মহাপাপ।
(সূরা ইসরা-৩১)
অন্যত্র তিনি বলেন, الشَّيْطَانُ يَعِدُكُمُ الْفَقْرَ শয়তান তোমাদের অভাবের ওয়াদা দেয়। (সূরা বাকারা-২৬৮)
দলীল:
আযলের ব্যাপারে দু'ধরনের হাদিস বর্ণিত হয়েছে।কিছু হাদিসে আযলের অনুমতি আর কিছু হাদিসে নিষেধ করা হয়েছে।যেমন,
এক.হাদীস শরীফে এসেছে,
عن جابر ، كنا نعزل على عهد النبي ﷺ
জাবের রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: আমরা রাসূলুল্লাহ ﷺ এর যুগে আযল করতাম। (বুখারী ২/৭৮৪)
দুই.অন্য হাদিসে এসেছে,
وفي المشكاة ٥ /٣١٧
٣١٨٩-وعن جذامة بنت وهب، قالت : حضرت رسول اللّٰه صلى اللّٰه عليه وسلم في أناس وهو يقول : لقد هممت أن أنهى عن الغيلة، فنظرت فى الروم و الفارس، فإذا هم يغيلون أولادهم، فلا يضر أولاهم ذلك شيئا.ثم سألوه عن العزل،فقال رسول اللّٰه صلى اللّٰه عليه وسلم : ذلك الوأد الخفي وهي وإذا الموؤودة سئلت. رواه مسلم
قال المصنف رح : وهذا دليل لمن لم يجوز العزل. ومن جوزه يقول هذا منسوخ أو تهديد أو بيان الأولى و هو الأولى
সহীহ মুসলিমের উক্ত হাদিসে আযলকে الوأد الخفي বলা হয়েছে তথা সুক্ষ্মভাবে সন্তানকে মেরে ফেলা।
দুই হাদিসের মাঝে সামঞ্জস্যতা বিধান করে উলামায়ে কেরাম বলেন : আযল করা জায়েজ,তবে মাকরূহ তথা অনুচিত।
২.পিল,ঔষধ কিংবা ইনজেকশন দেওয়ার হুকুম:
এ পদ্ধতি স্বাভাবিক অবস্থায় নাজায়েজ।কেননা,এ পদ্ধতি তুলনামূলক দীর্ঘমেয়াদী হওয়ার পাশাপাশি স্বাস্থ্যসম্মত নয়।তবে শুধু নিম্নোক্ত ক্ষেত্রে বৈধ হবে।
- দুই বাচ্চার জন্মের মাঝে কিছু সময় বিরতি দেওয়া, যাতে প্রথম সন্তানের লালন-পালন, পরিচর্যা ঠিকমতো হয়।
- কোন কারণে মহিলার বাচ্চা লালন-পালনের সামর্থ্য না থাকলে।
- মহিলা অসুস্থ ও দুর্বল হওয়ার কারণে গর্ভধারণ বিপজ্জনক হলে।
তবে ভালোভাবে মনে রাখা দরকার যে, এসব ক্ষেত্রে বৈধতা শুধু ব্যক্তিগত প্রয়োজনে। সম্মিলিতভাবে মানুষের কাছে প্রচারণা করা ও এতে উদ্বুদ্ধ করা কোনোভাবেই জায়েজ নয়।
৩)তৃতীয় পদ্ধতি বা গর্ভপাতের হুকুম:
তৃতীয় পদ্ধতিও নাজায়েজ।তবে গর্ভস্থ সন্তানের কারণে যদি গর্ভবতী মায়ের জীবন হুমকির মুখে পড়ে, বিষয়টি যদি নিরপেক্ষ ও অভিজ্ঞ দ্বীনদার ডাক্তারের মাধ্যমে নির্দেশিত হয়, তাহলে গর্ভস্থ সন্তানের বয়স চার মাস হওয়ার আগে গর্ভপাত বৈধ হবে।আর বয়স চার মাসের অধিক হলে কোনো অবস্থাতেই বৈধ হবে না।
কেননা, হাদিসের ভাষ্য থেকে জানা যায়, গর্ভস্থ সন্তানের বয়স চার মাস পূর্ণ হলে তার দেহে রূহ বা আত্মা ফুঁকে দেওয়া হয়। আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন,
إِنَّ أَحَدَكُمْ يُجْمَعُ خَلْقُهُ فِيْ بَطْنِ أُمِّهِ أَرْبَعِيْنَ يَوْمَاً نُطْفَةً، ثُمَّ يَكُوْنُ عَلَقَةً مِثْلَ ذَلِكَ،ثُمَّ يَكُوْنُ مُضْغَةً مِثْلَ ذَلِكَ،ثُمَّ يُرْسَلُ إِلَيْهِ المَلَكُ فَيَنفُخُ فِيْهِ الرٌّوْحَ،وَيَؤْمَرُ بِأَرْبَعِ كَلِمَاتٍ: بِكَتْبِ رِزْقِهِ وَأَجَلِهِ وَعَمَلِهِ وَشَقِيٌّ أَوْ سَعِيْدٌ
"তোমাদের সকলের সৃষ্টি নিজের মায়ের পেটে চল্লিশ দিন যাবৎ শুক্ররূপে জমা হওয়ার মাধ্যমে শুরু হতে থাকে, পরবর্তী চল্লিশ দিন জমাট বাঁধা রক্তরূপে থাকে, পরবর্তী চল্লিশ দিন গোশতপিণ্ড রূপে থাকে, তারপর তার কাছে ফিরিশতা পাঠানো হয়। অতঃপর সে তার মধ্যে রূহ প্রবেশ করায় এবং তাকে চারটি বিষয় লিখে দেয়ার জন্য হুকুম দেয়া হয়- তার রুজি, বয়স, কাজ এবং সে কি সৌভাগ্যবান না দুর্ভাগ্যবান।" (বুখারি ৩২০৮)
আল্লামা ইবনে তাইমিয়া রহ. বলেন,
উম্মতে মুসলিমার সকল ফুকাহায়ে কেরাম এ ব্যাপারে একমত যে, রূহ আসার পর গর্ভপাত করা সম্পূর্ণ নাজায়েজ ও হারাম। কারণ এটা الوأد (জীবন্ত কবর দেওয়া) এর অন্তর্ভুক্ত; যে ব্যাপারে আল্লাহ তাআলা বলেন, وَإِذَا الْمَوْءُودَةُ سُئِلَتْ،بأي ذَنْبٍ قُتِلَتْ ‘যখন (কেয়ামতের দিন) জীবন্ত প্রোথিত কন্যাকে জিজ্ঞেস করা হবে, কোন অপরাধে তাকে হত্যা করা হয়েছে?(সূরা তাকভীর-৮) [ফাতাওয়া ইবনে তাইমিয়া ৪/২১৭]
(২)প্রাকৃতিক পদ্ধতির শরয়ী বিধান:
ডাক্তারদের গবেষণা অনুযায়ী এমন কিছু দিন রয়েছে,যখন সহবাস করলে সাধারণত গর্ভধারণ হয় না।এভাবে জন্মনিয়ন্ত্রণ করা বৈধ যদি বদ আকীদা যুক্ত না হয়।যেমন,রিজিকের ভয়ে,কন্যা সন্তানের ভয়ে ইত্যাদি।
প্রামাণ্য গ্রন্থাবলী:
১.জাদীদ ফিকহী মাসায়েল ১/১৯৮-২০৩
২.জাওয়াহিরুল ফিকহ ৭/৭৯-৯৩
والله تعالىٰ أعلم بالصواب
উত্তর প্রদানে-
মুফতী হোসাইন আহমদ যায়েদ