শরয়ী সফরের দূরত্ব কত কিলোমিটার?

প্রশ্ন:

শরয়ী সফরের দূরত্ব কত কিলোমিটার?কেউ বলেন,৭৭ কি.মি.,কেউ বলেন ৮৩ কি.মি.,কেউ বলেন ৮৭ কি.মি.।আমাদের আকাবিরদের তাহকীকসহ জানতে চাই। 

উত্তর:

بسم اللّٰه الرحمن الرحيم 

শরয়ী সফরের পরিমাণ:

১)পায়ে হেঁটে তিনদিনের সফরের দূরত্ব:

হানাফী মাযহাব অনুযায়ী শরয়ী সফরের পরিমাণ হলো-পায়ে হেঁটে তিনদিনের স্বাভাবিক সফরের  দূরত্ব।(একে তিন মারহালা বলেও ব্যক্ত করা হয়েছে ফিকহী কিতাবাদিতে।এক মারহালা হলো একদিনের স্বাভাবিক সফরের দূরত্ব।)এ মতের উপর হানাফী মাযহাবের ফতোয়া।এ মতটি বিভিন্ন হাদিস ও আসারে সাহাবা দ্বারা প্রমাণিত।তন্মধ্যে একটি হাদিস হলো-

وفي صحيح مسلم ١٣٤٠: عن أبي سعيد الخدري رض قال: قال رسول اللّٰه صلى اللّٰه عليه وسلم : لا يحل لامرأة تؤمن بالله و اليوم الآخر أن تسافر سفرا يكون ثلاثة أيام فصاعدا إلا و معها أبوها أو إبنها أو زوجها أو أخوها أو ذو محرم منها.

অর্থাৎ-আবূ সাঈদ রা. হতে বর্ণিত,তিনি বলেন:রাসূল صلى اللّٰه عليه وسلم বলেছেন: কোনো ঈমানদার মহিলার জন্য তিন বা ততোধিক দিনের দূরত্বে একাকী সফর করা বৈধ নয়; তবে যদি সাথে বাপ,ছেলে,স্বামী,ভাই কিংবা অন্য কোনো মাহরাম থাকে,তাহলে সফর করা বৈধ।

(সহীহ মুসলিম-১৩৪০)

এই হাদিস থেকে স্পষ্ট বুঝা যায় যে,শরয়ী সফরের পরিমাণ হলো তিনদিনের দূরত্ব।কেননা মহিলাদের শরয়ী সফরের ক্ষেত্রেই মাহরাম থাকা আবশ্যক।যদিও ফেতনার আশংকা না থাকে।

এ বিষয়ে নিচের আসারটি লক্ষনীয়,

وفي كتاب الآثار للإمام محمد رح ص٢٠٠ : عن علي بن ربيعة الوالبي قال: سألت عبد اللّٰه بن عمر رض إلى كم تقصر الصلاة؟فقال: أتعرف السويداء؟قال: قلت: لا،ولكني قد سمعت بها.قال: هي ثلاث ليال قواصد،فإذا خرجنا إليها قصرنا الصلاة. 

قال العلامة النيموي رح: وإسناده صحيح.آثار السنن،ص٢٥٨

قال العلامة ظفر أحمد العثماني رح: رجاله ثقات من رجال الصحيحين.إعلاء السنن ٧ /٢٧٤

অর্থাৎ-আলী ইবনে রাবীআ আলওয়ালিবী হতে বর্ণিত,তিনি বলেন: আমি আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রা. কে জিজ্ঞেস করলাম- কি পরিমাণ দূরত্বে কসরের নামাজ পড়া হবে?তিনি বললেন: সুয়াইদা এলাকা চিনো?আমি বললাম: না,তবে নাম শুনেছি। তখন তিনি বললেন: তা হলো তিন রাতের দূরত্ব। আমরা যখন ঐ এলাকায় যেতাম,তখন কসর করতাম। (কিতাবুল আসার, পৃষ্ঠা-২০০)

ইমাম নববী রহ. বলেন,এ হাদিসের সনদ সহীহ।

(আসারুল সুনান,পৃষ্ঠা-২৫৮)

আল্লামা জাফর আহমদ উসমানী রহ. বলেন,এই আসারের রাবীগণ সবাই সিকাহ(তথা সনদ সহীহ)।

এ'লাউস সুনান ৭/২৭৩

২)১৫ বা ১৮ ফরসখ:

ফিকহে হানাফীর কিছু কিতাবে ১৫ ফরসখ (৪৫ শরয়ী মাইল) বা ১৮ ফরসখ (৫৪ শরয়ী মাইল) এর উপর ফতোয়া বলা হয়েছে।এসব মত মূল মাযহাবের বিপরীত; যেমনটা বলেছেন ইবনে নুজাইম রহ.।অথবা এগুলোর ভিত্তি হলো তিন দিনের দূরত্ব; যেমনটা ব্যাখ্যা করেছেন আল্লামা ইবনুল হুমাম রহ. এবং আল্লামা শামী রহ.।অর্থাৎ তারা স্ব স্ব এলাকায় পরীক্ষা করে দেখেছেন যে,তিন দিনে এ পরিমাণ দূরত্ব অতিক্রম করা যায়।আর একেকজন একেক নিয়মে পরীক্ষা করেছেন।

উল্লেখ্য যে,শরয়ী সফরের পরিমাণ ৪৫ শরয়ী মাইল তথা ৮২.২৬ কি.মি.(প্রায় ৮৩ কি.মি.); এমতের পক্ষে রয়েছেন মুফতী সালমান মানসূরপুরী দা.বা.,মুফতী শাব্বির আহমদ  কাসেমী দা.বা.সহ আরো কতেক মুফতীয়ানে কেরাম।তবে তাদের কেউ কেউ ৭৭.২৪৮ কি.মি; এ মতের উপরেও আমল করার অবকাশ রয়েছে বলে ব্যক্ত করেছেন আকাবিরীনদের ফতোয়ার উপর ভিত্তি করে।

(ইজাহুল মাসায়েল,পৃষ্ঠা ৬৮-৭১;কিতাবুন নাওয়াযেল ৫/৩৯৩-৩৯৫)

আকাবীরে দেওবন্দের তাহকীক:

আমাদের দেওবন্দী উলামায়ে কেরাম পরীক্ষা করে দেখেছেন যে,তিন দিনে পায়ে হেঁটে স্বাভাবিকভাবে ৪৮ ইংরেজি মাইল অতিক্রম করা যায়।এ হিসাবে তারা ফতোয়া দিয়েছেন যে,শরয়ী সফরের দূরত্ব ৪৮ ইংরেজি মাইল বা ৭৭.২৪৮ (প্রায় ৭৮ কি.মি.)।

তাঁদের কয়েকজনের নাম নিচে তুলে ধরা হলো-

১.মাওলানা কাসেম নানুতবী রহ.

২.মাওলানা রশিদ আহমদ গাঙ্গুহী রহ.

৩.মাওলানা ইয়াকুব নানুতবী রহ.

৪.শাইখুল হিন্দ মাহমুদ হাসান রহ.

৫.মাওলানা আশ্রাফ আলী থানভী রহ.

৬.মুফতী আযীযুর রহমান রহ.

৭.মুফতী মাহমুদ হাসান গাঙ্গুহী রহ.

৮.মুফতী আব্দুর রহীম লাজপুরী রহ.

৯.মুফতী শফী রহ.

১০.মাওলানা মাসীহুল্লাহ খান জালালাবাদ রহ.

১১.মুফতী নেযামুদ্দীন রহ.

১২.মুফতী জফীরুদ্দীন

১৩.মুফতী হাবীবুর রহমান

১৪.মাওলানা মুজাফফর হোসাইন রহ.

১৫.মুফতী আমীন সাহারানপুর

১৬.মুফতী মাজদুল কুদ্দুস সাহারানপুর

১৭.মুফতী ইয়াহইয়া সাহারানপুর

১৮.মুফতী আসরার জালালাবাদ 

১৯.মাওলানা আব্দুর রশিদ মাহমুদ সাহেব

২০.মাওলানা নাসির আহমদ জালালাবাদ 

২১.মাওলানা আব্দুল্লাহ সাহেব জৈনপুর

২২.মাওলানা বুরহানুদ্দিন লক্ষ্মৌ

২৩.মাওলানা নুরুল হাসান রাশেদ সাহেব

২৪.মাওলানা আনজার শাহ কাশ্মীরী রহ.

২৫.মাওলানা রশিদ আহমদ লুধিয়ানভী রহ.

(আল-আওযানুল মাহমুদা,মুফতী আবুল কালাম শফীক কাসেমী মাজাহিরী,পৃষ্ঠা ৯৬-৯৭)

সুতরাং ভারত,পাকিস্তান,আফগানিস্তান ও বাংলাদেশে আকাবীরে দেওবন্দের তাহকীক অনুযায়ী ফতোয়া দেওয়া হবে।কেননা এসব দেশের অধিকাংশ ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা তাদের ফতোয়া অনুযায়ী আমল করে আসতেছেন।

সারকথা,

অধিকাংশ আকাবীরে দেওবন্দের তাহকীক হলো শরয়ী সফরের পরিমাণ ৪৮ ইংরেজি মাইল তথা ৭৭.২৪৮ কি.মি.।কেননা এক ইংরেজী মাইল হলো ১.৬০৯ কি.মি.। আকাবিরদের বিভিন্ন কিতাবাদিতে ৪৮ মাইল দ্বারা শরয়ী মাইল উদ্দেশ্য নয়,যার পরিমাণ ৮৭.৭৪৪ কি.মি.।কেননা হানাফীদের নিকট শরয়ী এক মাইল হলো ১.৮২৮ কি.মি.।উলামায়ে দেওবন্দের মধ্যে সর্বপ্রথম এ মতটি ব্যক্ত করেছেন "আহসানুল ফাতাওয়া" এর মুসান্নিফ মুফতী রশিদ আহমদ লুধিয়ানবী রহ.।কিন্তু পরবর্তীতে তিনি এ মত থেকে রুজু' করে ৭৭.২৪৮ কি.মি. এই মত অনুযায়ী ফতোয়া দিয়েছেন।(আহসানুল ফাতাওয়া ৪/৯৬-১০৬)

উল্লেখ্য যে,

অন্যান্য মাযহাবে শরয়ী সফরের পরিমাণ হলো ৪ বারীদ তথা ৪৮ শরয়ী মাইল।তবে মাইলের পরিমাণ নিয়ে মতপার্থক্য থাকায় তাদের মাঝেও মতানৈক্য হয়ে গেছে।

শাফেয়ী ও হাম্বলী মাযহাবে শরয়ী এক মাইল হলো ২.৭৪৩ কি.মি.।এ হিসাবে শরয়ী সফরের পরিমাণ হয় ১৩১.৬৭৩ কি.মি.।

আর মালেকী মাযহাবে শরয়ী এক মাইল হলো ২.৪০০ কি.মি.।এ হিসাবে শরয়ী সফরের পরিমাণ হয় ১১৫.২১৪ কি.মি.।

বিস্তারিত দলীলসহ তাহকীকী আলোচনা মুফতী আব্দুর রহমান কাসেমী আজীমাবাদী দা.বা. কর্তৃক লিখিত "মিফতাহুল আওযান" এ রয়েছে। 

তথ্যসূত্র:

(١)الأصل : ١ / ٢٣١ للإمام محمد رح، تحقيق: الدكتور بوينوكالن

قلت: أرأيت المسافر هل يقصر الصلاة في أقل من ثلاثة أيام؟ قال: لا

قلت: فإن سافر مسيرة ثلاثة أيام  فصاعدا؟ قال: يقصر الصلاة حين يخرج من مصره

قلت: ولم وقت له ثلاثة أيام ؟ قال: لأنه جاء أثر عن النبي صلى اللّٰه عليه وسلم أنه قال: "لا تسافر المرأة ثلاثة أيام إلا ذو محرم"، فقست على ذالك

(٢)فتح القدير:٢ /٢٩،دار الكتب العلمية

قوله:(هو الصحيح) احتراز عما قيل يقدر بها فقيل بأحد و عشرين فرسخا،وقيل بثمانية عشر،وقيل بخمسة عشر،وكل من قدر يقدر منها اعتقد أنه مسيرة ثلاثة أيام، وإنما كان الصحيح أن لا يقدر بها لأنه لو كان الطريق وعرا بحيث يقطع في ثلاثة أيام أقل من خمسة عشر فرسخا قصر بالنص

(٣)رد المحتار: ٢/ ٦٠٢،دار عالم الكتب

وكذا ما في الفتح من أنه قيل: يقدر بأحد و عشرين فرسخا،وقيل بثمانية عشر،وقيل بخمسة عشر،وكل من قدر منها اعتقد أنه مسيرة ثلاثة أيام اھ.أي بناء على اختلاف البلدان،فكل قائل قدر ما في بلده من أقصر الأيام، أو بناء على اعتبار أقصر الأيام أو أطولها أو المعتدل منها

(٤)البحر الرائق :٢ /٢٢٨

وفي النهاية : الفتوى على اعتبار ثمانية عشر فرسخا.وفي المجتبى: فتوى أكثر أئمة خوارزم على خمسة عشر فرسخا اھ.وأنا أتعجب من فتواهم في هذا و أمثاله بما يخالف مذهب الإمام خصوصا المخالف للنص الصريح

(٥)اوزان شرعیہ: ص٥٤

الغرض مذہب مختار کے مطابق مسافت قصر تین منزل یا ٤٨ میل انگریزی ہے۔

(٦)احسن الفتاویٰ ٤ /٩٦-٩٧،ایچ ایم سعید ،طبع- یازدھم ١٤٢٥

مولانا مہربان علی صاحب بڑوتوی کا رسالہ "شرعی مسافت" موصول ہوا ،جس میں بندہ کے رسالہ "القول الأظهر في تحقيق مسافة السفر" پر تنقید ہے٫ اس سے متعلق چند امور تحریر کئے جاتے ہیں 

اس سے یہ حقیقت واضح ہوگئی کہ اقوال اکابر میں میل سے انگریزی میل ہی مراد ہے-اللہ تعالیٰ مؤلف کو جزاء خیر عطاء فرمائیں

وایضا- ٤ /١٠٥ بہر کیف اب اکابر کی مراد اور انکے فتویٰ کی بناء واضح ہوگئی تو میں اپنی تحریر سابق سے رجوع کرتا ہوں 

مسافت سفر -٤٨ ميل انگریزی/ ٧٧.٢٤٨٥ کلومیٹر ۔

(٧)مفتاح الأوزان:ص٩٥

الحاصل اس وقت ہمارے علماء دیوبند کا فتویٰ یہ ہے کہ مسافت سفر ٤٨ میل انگریزی ہے،اور ایک میل انگریزی ہوتا ہے

 ١ کلومیٹر،٣٤٤ ملی میٹر کا ، لہذا ٤٨ میل انگریزی کا مجموعہ: ٧٧ کلومیٹر ، ٢٤٨ میٹر ، ٥٥٢ ملی میٹر ہوگا۔

(٨) مسائل المیزان: ص ١٦٩

سفر شرعی كی حد ٤٨ ميل انگریزی ہیں۔

(٩) بہشتی زیور ص٢٠٧، بیت العلم ٹرسٹ 

 تین منزل یہ ہے کہ اکثر پیدل چلنے والے وہاں تین روز میں پہنچا کرتے ہیں ، تخمینہ اس کا ہمارے ملک میں کہ دریا اور پہاڑ میں سفر نہیں کرنا پڑتا اڑتالیس میل انگریزی ہے۔

(١٠)الأوزان المحمودة ص ٩٥

بعض حضرات نے ٨٢/کلومیٹر ٢٩٦/میٹر کو سفر شرعی كی مسافت اور اس کو راجح بتایا ہے جو جمہور علماء اور اکابر علماء ہند کے قول و فتویٰ کے بالکل خلاف ہے ۔

والله تعالىٰ أعلم بالصواب

উত্তর প্রদানে-

মুফতী হোসাইন আহমদ

মুশরিফ,ফতোয়া বিভাগ

ইসলামী দাওয়াহ সেন্টার সাইনবোর্ড,ঢাকা।

প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক: মুফতী শামসুদ্দোহা আশরাফী হাফি.

Next Post Previous Post
1 Comments
  • মরিয়ম
    মরিয়ম ১৫ আগস্ট, ২০২৪ এ ৮:৩৭ PM

    জাযাকাল্লাহ

Add Comment
comment url